জড়ভরত

পুরাকালে শালগ্রাম নগরে ভরত নামের পরম হরিভক্ত এক রাজা ছিলেন। একদা রাজা ভরত মহানদীর তীরে আশ্রম স্থাপন করলেন এবং একমনে হরিপূজা করতে লাগলেন।

একদিন আশ্রমের নিকটে এক হরিণীকে দেখে ভরত বেশ মমতা অনুভব করেন। সিংহের গর্জনে ভীত হয়ে হরিণীটি নদীর পাড় থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়, এবং তার ছানাটি নদীর স্রোতে ভেসে যেতে থাকে।

ভরত হরিণ-ছানাটিকে উদ্ধার করে আশ্রমে নিয়ে আসেন এবং যত্নের সাথে তাকে পালন করতে থাকেন।

ক্রমেই হরিণ-ছানাটি ভরতের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে; এমনকি হরিণটি বাইরে গেলেও ভরত তার নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকতেন। 

ফলে তার সাধনজীবন ব্যাহত হতে লাগলো এবং ধীরে ধীরে হরিভজন থেকে তার মন দূরে সরে গেলো। হরিণ-ছানাটির যত্ন করতে করতেই একদিন তিনি মারা গেলেন।

মৃত্যুর পরে কালক্রুর পর্বতে ভরত হরিণরূপে জন্ম নেন এবং পরবর্তীতে ব্রাহ্মণরূপে পুনর্জন্ম লাভ করলেন।

ব্রাহ্মণরূপে ভরত নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতেন এবং সাধারণ ব্রাহ্মণদের মতো আচরণ করতেন না, ফলে লোকেরা তাঁকে পাগল মনে করত।

পিতার মৃত্যুর পর খাদ্যের বিনিময়ে তিনি গ্রামবাসীদের চাষবাসের সব কাজ করে দিতেন। একদিন রাজা সৌবীর পাল্কীতে চড়ে কপিলমুনির আশ্রমে দুঃখপূর্ণ সংসারে মানুষের কর্তব্য জানতে যাচ্ছিলেন।

রাজার লোকেরা পাল্কী বহনের জন্য অন্য বাহকদের সাথে ব্রাহ্মণ ভরতকে ধরে আনলেন। পূর্বজন্মের কথা ভরতের সমস্তই মনে ছিল, তাই পাপ ক্ষয়ের নিমিত্ত তিনি পাল্কী বহিতে কোনরূপ আপত্তি করলেন না।

পাল্কীর অন্য বাহকগণ দ্ৰুত চলছিল কিন্তু অনভ্যাসবশত ভরত ধীরে চলছিলেন। ফলে পাল্কীতে একটি ঝাঁকুনি তৈরি হচ্ছিল। রাজা বেশ বিরক্ত হলেন এবং ঝাঁকুনি বন্ধ করতে বললেন।

পাল্কীর অন্য বাহকগণ রাজাকে বললো, ব্রাহ্মণ ভরতের অলসতার জন্য এমন ঝাঁকুনি তৈরি হচ্ছে। রাজা ব্রাহ্মণ ভরতে ওপর ক্ষুব্ধ হলেন।

ফলে তিনি রাজাকে বললেন, “মহারাজ! আমি শিবিকা বহন করিতেছি, একথা মিথ্যা।

এই যাহা দেখিতেছেন, তাহা আমার শরীর মাত্র; আমার পা দুইটি মাটির উপর দাড়াইয়াছে, পায়ের উপর যথাক্রমে পেট, বুক, হাত ও কাঁধ রহিয়াছে, আর সেই কাঁধের উপরে পাল্কী৷

তাহা হইলে, আমি পাল্কী বহন করিতেছি–একথা কি মিথ্যা হইল না? পঞ্চভূতের শরীর—তুমি, আমি এবং অন্য সমস্ত জীবকেই পঞ্চভূতে বহন করিতেছে! গাছপালা, বাড়ীঘর, পাহাড়-পর্বত সমস্তই পঞ্চভূতের ব্যাপার।

সুতরাং, যদি বল আমার উপর পাল্কীর ভার রহিয়াছে, তবে একথাও বলিতে পার যে, অন্য সমস্ত প্রাণিগণের উপরও শুধু শিবিকা নয়— সমস্ত পৃথিবীর ভারটা চাপান রহিয়াছে।”

ব্রাহ্মণের এই কথায় রাজা তার অন্তর্নিহিত জ্ঞানের উপলব্ধি করেন। তিনি ব্রাহ্মণের পা ধরে অনুরোধ করেন, ‘দুঃখপূর্ণ সংসারে মানুষের কর্তব্য কি’ তা যেনো তিনি রাজাকে বুঝিয়ে দেন।

ব্রাহ্মণ ভরত তখন রাজা সৌবীরকে তাঁর জীবনের গল্প বললেন এবং নানাবিধ উপদেশ দেন। এভাবে তিনি তার লুপ্তশক্তি ও দিব্য জ্ঞান পুনরুদ্ধার করে মুক্তিলাভ করেন।