You are currently viewing blog-single.phpবনলতা সেন

বনলতা সেন

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে আরো দূর অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনই দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে চাওয়া নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী; ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

জীবনের ক্লান্তি, পথ চলার অবসাদ, এবং শান্তি খুঁজে পাওয়ার গভীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লেখা জীবনানন্দ দাশের কালজয়ী কবিতা “বনলতা সেন”। কবিতার মূলভাব নিম্নরূপ:

অন্তহীন পথচলা ও ক্লান্তি:
কবিতার বক্তা হাজার বছরের পথচলার মাধ্যমে এক ক্লান্ত, দিশাহীন পথিক। সিংহল সমুদ্র থেকে বিদর্ভ নগরে ঘুরে বেড়ানো এই পথিকের জীবন যেন এক অনন্ত যাত্রা, যা ক্লান্তি ও বিষণ্নতায় পরিপূর্ণ।

শান্তি ও আশ্রয়ের প্রতীক:
নাটোরের বনলতা সেন এই ক্লান্ত পথিকের জন্য এক শান্তি ও আশ্রয়ের প্রতীক। তার সৌন্দর্য, কোমল ব্যবহার এবং স্নিগ্ধ উপস্থিতি জীবনের ঝড়জলাতঙ্ক থেকে মুক্তির প্রতিচ্ছবি।

অতীত, প্রকৃতি, ও মানুষের সংযোগ:
কবিতার বিভিন্ন অংশে ইতিহাসের নানা সময় এবং প্রকৃতির বর্ণনা কবিতার বক্তব্যকে গভীরতা প্রদান করে। বনলতা সেন যেন অতীতের সৌন্দর্য ও প্রাচীন ঐতিহ্যের মূর্ত প্রতীক।

জীবনের পরিণতি ও নীরবতার আহ্বান:
কবিতার শেষ স্তবকে জীবনের লেনদেন শেষ হয়ে যাওয়ার পর নীরবতার মধ্যে বসিবার একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। এই নীরবতা এবং বনলতা সেনের সাথে মুখোমুখি বসা জীবন ও মৃত্যুর মাঝের শান্তিপূর্ণ অবস্থার ইঙ্গিত বহন করে।

জীবনের ক্লান্তি, সৌন্দর্য, এবং শান্তির সন্ধানই এই কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। নাটোরের বনলতা সেন জীবনের ঝঞ্ঝাটময় পথযাত্রার শেষে সেই নিরুপম শান্তির প্রতীক।