সাম্যবাদী

কাজী নজরুল ইসলাম

গাহি সাম্যের গান— 

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, 

যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রিশ্চান।

গাহি সাম্যের গান!

কে তুমি? — পার্সি? জৈন? ইহুদি? সাঁওতাল, ভীল, গারো?

কনফুসিয়াস? চার্বাক-চেলা? বলে যাও, বলো আরো!

বন্ধু, যা খুশি হও, 

পেটে-পিঠে, কাঁধে-মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও, 

কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক— 

জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও যত শখ  — 

কিন্তু কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল? 

দোকানে কেন এ দর-কষাকষি? — পথে ফোটে তাজা ফুল! 

তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,

সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ! 

তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার, 

তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকলের দেবতার । 

কেন খুঁজে ফের দেবতা-ঠাকুর মৃত-পুঁথি-কঙ্কালে?

হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।

বন্ধু, বলিনি ঝুটি,

এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট। 

এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, 

বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন, 

মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়, 

এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয় । 

এই রণ-ভূমে বাঁশির কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,

এই মাঠে হলো মেষের রাখাল নবিরা খোদার মিতা।

এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি 

ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি।

এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান, 

এইখানে বসি গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান! 

মিথ্যা শুনিনি ভাই,

এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।