প্রতিদিনের মতো সেইদিনও রাজপুর এলাকার ছেলেরা একসাথে ক্রিকেট খেলছিলো, এমন সময় মধ্যবয়সী শিমুল হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে তাদের কাছে আসলো।
শিমুলকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে খেলা থামিয়ে সবাই তার কাছে গেলো এবং তাকে ঘিরে ধরলো। হাঁপাতে হাঁপাতে শিমুল বললো, “আগে একটু পানি দে তো, ভাই। আগে পানি খেয়ে ঠান্ডা হই।”
সুমন দৌড়ে পানির বোতল এনে দিল। শিমুলের পানি খাওয়া হলে সকলে একসাথে বলতে লাগলো, “এইবার বলো, শিমুল ভাই।”
“শোন… আজকে ঐ এলাকার রাজুর সাথে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে বলতে একটা বড়সর ক্যাচাল হয়ে গেছে। সে তুমুল অবস্থা, আশেপাশের সব লোক জড়ো হয়ে গেছিল।
শেষমেস সিদ্ধান্ত হলো, আগামীকাল এই এলাকা আর ঐ এলাকার মধ্যে একটা ক্রিকেট ম্যাচ হবে। তোরা সবাই রেডি তো?”
জোরালো কণ্ঠে সকলে উত্তর দিলো, “একদম ফাটিয়ে দিব, শিমুল ভাই। তুমি চিন্তা করো না।”
শিমুল বললো, “ঠিক আছে। শোন… আমি হলাম তোদের কোচ আর টিমের ক্যাপ্টেন হচ্ছে রোমেল।”
শান্তশিষ্ট চুপচাপ রোমেলকে ক্যাপ্টেন ঘোষণা করায় অনেকে বেশ অবাক হলো এবং শিমুলকে বললো, “ভাই… রোমেল!! হ্যাঁ, ও ভালো খেলে ঠিকই কিন্তু ভালো খেলোয়াড় যে ভালো ক্যাপ্টেন হতে পারবে এমন তো কোনো কথা নেই।”
শিমুল হেসে বললো, “কোচ কে?” সবাই ইশারায় শিমুলকে দেখালো। “তাহলে এত কথা না। রোমেল বাদে সবাই এখন বাসায় যা, কাল ভোরে মাঠে আসিস। ১০টা থেকে ম্যাচ, এর আগে আমরা একটু বসবো।”
পরদিন ভোরে সবাই মাঠে চলে আসলো। খেলার সব স্ট্রাটেজি ঠিক করা হলো।
১০টা বাজে। খেলা শুরু হয়েছে।
টসে হেরে রোমেলের টিম ফিল্ডিং পেয়েছে। এতে কোচ শিমুল খুশি হলেও বাকিরা বেশ টেনশনে আছে। পাশের এলাকার খেলোয়াড়রা সব বাঘা, ওদের তুলনায় রাজপুর কিছুই না।
শিমুলদের সময় রাজপুরে এমন বাঘা খেলোয়াড় অনেক ছিল, কিন্তু এখন হাতেগোনা দুই একজন খুব ভালো খেলে। রোমেল সবাইকে তাদের পজিশন বলে দিল।
প্রথম ৩ বলেই রোমেলের দল ৩টা ছক্কা খেলো। যারা রোমেলের ক্যাপ্টেন্সির বিপক্ষে ছিল তারা অনেকটা শিমুলের দিকে তেড়ে গেলো।
শান্ত কণ্ঠে রোমেল তাদের বললো, “আহা… দেখোই না। কেবল তো খেলা শুরু হলো!”
রোমেল বরাবরের মতোই চুপচাপ, কোনো উত্তেজনা নেই। ওভারটা শেষ হওয়ার পর সে নতুন করে ফিল্ডার সাজালো। দ্বিতীয় ওভারে রোমেল নিজেই বল করলো এবং দুই বল খেলেই ব্যাটসম্যান আউট।
রোমেলের দলের সবাই খুশি আত্মহারা হয়ে পড়লো। এভাবে ২০ ওভারের খেলায় মাত্র ১৪ ওভারেই প্রতিপক্ষকে অলআউট করে দিল তারা। রান দিয়েছে ১১৩।
ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হলো। পাশের এলাকার ছেলেরা বেশ উৎফুল্ল, রাজপুর এলাকার ছেলেদেরকে হারানো তাদের জন্য কোনো ব্যাপারই না।
কিন্তু প্রথম ৩ ওভারে তারা কোনো উইকেটই ফেলতে পারলো না। তবে তারা খুব একটা বেশি রানও করতে দেয়নি রাজপুরকে। ৩ ওভারে রোমেলের টিম মাত্র ৭ রান করতে পেরেছে।
চতুর্থ ওভার থেকেই একের পর এক উইকেট পড়তে লাগলো। ৭ উইকেটে রোমেল নামল।
ইতিমধ্যে শিমুল নিজের উপরে বেশ বিরক্ত। সে ভাবছে, আসলেই রোমেলকে ক্যাপ্টেন বানানো আমার ঠিক হয়নি। কত করে বললাম ওকে ৩-এ নামতে কিন্তু ছেলেটা কথাই শুনেনা।
রোমেল মাঠে নামার পর আরেকটা উইকেট গেলো। ৫ ওভারে ৩৭ রান বাকি। টি২০-এর হিসেবে কম হলেও, এই রান তোলা রাজপুরের জন্য বেশ কঠিন।
নতুন ব্যাটসম্যানের প্রতিও খুব একটা ভরসা নাই। সে কতক্ষণ ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে, সেটাই মূলত ভাবনার বিষয়।
কিন্তু প্রতিটা বল আসার আগে রোমেল তার পার্টনারকে কী যেনো বলে আর সে বেশ ভালোভাবেই নিজেকে ক্রিজে টিকিয়ে রাখে। সুযোগ পেলে ১ রান নেয়।
রোমেল স্ট্রাইকে থাকলে কখনোই ৪-৬ মিস যায় না। এভাবেই ৩টা ওভার পার হলো। চতুর্থ ওভারে রোমেলের পার্টনার আউট হয়ে গেলো। সবাই বেশ চিন্তিত কিন্তু রোমেল মোটেও বিচলিত হলো না।
সে একইভাবে তার নতুন পার্টনারকে প্রতিটা বলের আগে কী যেন বলতে থাকলো, এভাবে তাকেও রোমেল ক্রিজে টিকে রাখলো।
দেখতে দেখতে খেলা প্রায় শেষের দিকে চলে আসলো। ২ বলে ২ রান প্রয়োজন। সকলের মধ্যে টানটান উত্তেজনা। বোলারও নার্ভাস কারণ স্ট্রাইকে রোমেল আছে।
বল করা হলো। ডট গেলো। রাজাপুরের সবাই নিশ্চিত যে, আজ তাদের সম্মান অবশিষ্ট থাকছে না। কিন্তু রোমেল বরাবরের মতোই ধীরস্থির।
লাস্ট বল—রোমেল মাঠের ফাঁকা জায়গা দেখে বলটা বাউন্ডারি করলো, পাশে থাকা ফিল্ডাররা ফোর আটকানোর জন্য প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো এবং সবাইকে অবাক করে ফোর আটকে দিল তারা।
ইতিমধ্যে রোমেল তার পার্টনারের সাথে ২ রান নিয়ে ফেলেছে। ৪ উইকেটে রাজপুর জিতে গেলো।
জেতার উল্লাস শেষে সবাই যখন রোমেলকে জিজ্ঞেস করলো, এমন টানটান উত্তেজনার মধ্যেও সে কীভাবে এত শান্ত ছিল; তখন রোমেল মুচকি হেসে বললো—
“ক্রিকেট তো কৌশল আর ধৈর্যের খেলা। পিচে টিকে থাকার জন্য একজন কুল হেডেড ব্যাটম্যান দরকার হয়, সেই চ্যালেঞ্জটা আমি নিজেই নিয়েছিলাম।”