কৃপণ-পিসী জব্দ

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের একজন বিধবা পিসি ছিলেন। বুড়ির অগাধ টাকা-পয়সা, কিন্তু একেবারে হাটু-কেপ্পন। হাত থেকে জল গলে না। কাউকে একটা পয়সাও দেন না।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একদিন গোপালকে একান্তে ডেকে বললেন, “গোপাল, তুমি আমার পিসির কাছ থেকে যদি ৫০০ টাকা বাগিয়ে আনতে পার, তবে বুঝব তুমি প্রকৃতই চতুর-ব্যক্তি।

তোমাকে সকলেই যে চতুর বলে তার প্রমাণ এতেই হবে।”

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কথা শুনে গোপাল বললে, “এ আর তেমন কঠিন কাজ কি? আমি অল্প দিনের মধ্যেই আপনার কৃপণ পিসিকে জব্দ করে ৫০০ টাকা বাগিয়ে আনতে নিশ্চয়ই পারব। না পারি তো কানমলা খাব মহারাজ।”

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তখন গোপালকে বললেন, “গোপাল তুমি যদি আমার ওই কৃপণ পিসিমার কাছ থেকে টাকা বাগিয়ে আনতে পার—তবে যে টাকা তুমি বাগিয়ে আনবে, আমি সেই টাকার তিন গুণ তোমাকে দেব।

আমি হলফ করে বলতে পারি, আমার পিসির কাছ থেকে তুমি একটি কানাকড়িও বের করতে পারবে না। এমন কি কানমলা খেয়ে শেষে নাকানি চোবানি খেয়ে না ফিরে আসতে হয়। সাবধান হয়ে পিসির কাছে যাবে।”

গোপাল বললে, “দেখুন না মহারাজ, যাদু দেখিয়ে টাকা বের করে আনতে পারি কি না” এই বলে চলে গেল হাসতে হাসতে।

গোপাল পরদিনই উস্কো-খুস্কো পাগলের মতো হয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পিসির বাড়িতে গিয়ে হাজির হল, দেখলে চেনা যায় না। দেখলে মনে হয় ভীষণ অসুস্থ।

পিসি জিজ্ঞেস করলেন, “হঠাৎ এদিকে কি মনে করে গোপাল? তোমার একি চেহারা হয়েছে! তোমাকে পাগলের মতো দেখাচ্ছে কেন? তোমাকে দেখে আমার বড়ই দুঃখ হচ্ছে। তোমার কি ভীষণ অসুখ করেছিল?”

গোপাল মুখ কাঁচুমাচু করে বললে, “পিসিমা কিছুদিন আগে একজন নামকরা গণক-ঠাকুর হাত দেখে বলেছেন, আমার আয়ু নাকি আর মাত্র তিন মাস।

অনেকদিন থেকেই আমার মনের বাসনা আপনার পাতের প্রসাদ পাই। আপনি যদি আমার এই বাসনা পূর্ণ করেন, মরার আগে মনে একটু শান্তি পাব। সেইজন্যই এই অবস্থা।”

পিসি যতই কৃপণ হোক, একজন মৃত্যু-পথযাত্রী যদি পাতের প্রসাদ পেতে চায়, তাকে বারণ করেন কি করে?

তাই তিনি গোপালকে বললেন, “আহা! বালাই ষাট! এই কি তোমার মরবার বয়েস। তা তুমি যখন আমার পেসাদ পাবার জন্যে মনে মনে এতই বাসনা করেছ, তখন আগামী কাল আমার এখানে পেসাদ পেও।

তবে জানো তো বাবা, আমি বিধবা এবং বৈষ্ণবী হয়েছি, শুদ্ধ নিরামিষ খাই। তোমার কি আমিষ-খাওয়া মুখে নিরামিষ তরি তরকারি রুচবে? যদি রুচে তবে ভালই।”

গোপাল বললে, “খুব রুচবে পিসিমা। আমিও নিরামিষ আহার সবচেয়ে ভালোবাসি। আজকাল যা বাজার রোজ মাছ-মাংস পাবোই বা কোথা থেকে?”

পিসি বললেন, “বেশ বেশ, তবে বাবা কালই এসো কেমন? তোমার কথা আমার মনে থাকবে। তোমার যা মনের ইচ্ছে তাই যেন পূরণ হয়। ভগবান্ তোমার মঙ্গল করুন……………”

গোপাল মাথা নেড়ে বললে, “আচ্ছা আজ এখন তবে আমি আসি পিসিমা। কাল দুপুর বেলায় আমি আসব।”

পরদিন গোপাল ছেলেকে দিয়ে পুকুর থেকে কিছু কুঁচো চিংড়ি ধরে ভাল করে সিদ্ধ করে ট্যাকে গুঁজে নিয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পিসিমার মহলে হাজির হল দুপুর বেলায় পেসাদ পাবে বলে।

গোপাল তার এঁটো পাতেই খেতে বসবে বলে বুড়ি পিসি পাতে বেশ কিছু ভাত, লাউ-ঘণ্ট, শাক-ভাজা, বেগুন- ভাজা, আলু-ভাজা এবং অন্যান্য তরি-তরকারি, পায়েস রেখে দিয়েছিলেন।

গোপাল পিসির এঁটো পাতেই খেতে বসল আয়েস করে। পিসি বললেন, “গোপাল, তোমার বাছা আর যা যা দরকার লাগে, চেয়ে নিও; লজ্জা করে খেয়ো না যেন বুঝলে?”

গোপাল মাথা নাড়ল, “আচ্ছা। আমার যা দরকার চেয়ে নেব। এর জন্য চিন্তা করবেন না আপনি বিশ্রাম করতে যান্ আমার জন্য ভাবতে হবে না। আর দরকার হলে চেয়ে নেব।”

গোপাল খেতে খেতে এক ফাকে লাউঘণ্টের সঙ্গে কুঁচো চিংড়ি সিদ্ধ মিশিয়ে দিলে। লাউয়ের সঙ্গে সিদ্ধ-চিংড়ি দিলে ধরাই যাবে না।

গোপাল সবই খেল, কিন্তু পাতে কুঁচো চিংড়ি মেশানো কিছু লাউঘণ্ট রেখে দিল। পিসি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার আর কি দরকার বল? পেট ভরেছে তো গোপাল?”

গোপাল মুচকি হেসে বললে, “হ্যাঁ, খু-উ-ব ভরেছে পিসিমা। লাউ কুঁচো-চিংড়ির ঘণ্টটা খুব খাসা হয়েছে। আহা, কি চমৎকার খেতে! যাকে বলে অমৃত।

এরূপ কুচো চিংড়ির ঘণ্ট আমি কোনও দিন খাইনি। কিন্তু যদি আর একটু দেন তবে মন ভরে শেষ খাওয়া খেয়েনি। এছাড়া আমার আর কিছুই লাগবে না।”

পিসি অবাক হয়ে বললেন, “কি বললে! লাউ কুঁচো চিংড়ি? দূর পাগল, ওটা যে নিরামিষ লাউঘণ্ট! ওর মধ্যে আবার কুঁচো চিংড়ি তুমি পেলে কোথায়? তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে।”

গোপাল মুচকি হেসে বললে, “বিশ্বাস না হয়, আপনার ঝিকে ডেকেই দেখান না কেন। আমার পাতে এখনও একটুখানি লাউঘণ্ট পড়ে রয়েছে। কারণ এত আলু হয়েছে যে, পরে খাব বলে কিছু রেখে দিয়েছি। এটা আমার বরাবরের অভ্যাস।”

পিসি তখন মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, “ঝিকে ডাকার দরকার নেই। কৈ দেখি, চিংড়ি দেখেই বুড়ির চক্ষুস্থির। যাক্ বাবা, বুড়ো মানুষ কোথায় কি ভুল করে ফেলেছি।

একথা যেন আর পাঁচ-কান কোর না। হয়ত জনের সঙ্গে সিদ্ধ হয়ে গেছে। কারুকে কিছু বলো না বাবা। জলটা ছেঁকে রান্না করলে ভাল হত।”

গোপাল বললে, “আমি কি চুপ করে থাকতে পারি পিসিমা? মহারাজ জিজ্ঞাসা করলে কি বলব? ভাঁড়ের কাজ করি কথা বেচেই তো খেতে হয় আমায়। তাছাড়া আর ক’টা দিনই বা বাঁচব?

মরার আগে মিথ্যে কথা বলে পাপ বাড়িয়ে লাভ কি? ছেলে-পুলেদের জন্যে যদি কিছু না রেখে যেতে পারি তবে তাদের পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াতে হবে।

মহারাজকেও আমি মিথ্যা কথা বলতেই পারব না। খাওয়ার কথা মহারাজ জিজ্ঞাসা করলে, সত্যি কথাই তাঁকে বলতে হবে। পরে যদি শুনেন রাগ করবেন।”

কৃপণ পিসি তখন গোপালকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য বললেন, “আমি না-হয় তোমাকে দুটো-টাকা দিচ্ছি একথা আর কাউকে বোল না, তাহলে আমার মান সম্মান সব যাবে।”

গোপাল মুচকি হেসে বললে, “মাত্র দুটো-টাকা দিয়ে কি আর ভাঁড়ের মুখ বন্ধ রাখা যায় পিসিমা? তাছাড়া টাকা ঘুষ নেওয়াও যে পাপ। না পিসিমা, ও আমি পারব না।

মরার আগে মিথ্যে কথা বলতে কোনও মতেই পারব না। তবে যদি…”

পিসি বললেন, “থামলে কেন বাবা? তোমার মনের কথা বল না! যা বলার খুলে বল থেমে থেক না।”

গোপাল একটু থেমে বললে, “আপনার মুখ চেয়ে পাপকাজও করতে পারি পিসিমা; তবে বাপু হাজার খানেক টাকা লাগবে, তার কম হবে না। যখন মিথ্যে বলতেই হবে তবে বৌ-ছেলে-মেয়েদের জন্য কিছু বেশি করেই রেখে যাই।”

গোপালের কথা শুনে কৃপণ পিসি আঁৎকে উঠলেন, “বলো কি গোপাল। অত টাকা যদি দিতে হয় তবে যে আমিই তোমার আগে মারা পড়ব। আমি তোমাকে না হয় বিশ-পঁচিশ টাকাই দেব। এর বেশি আমার সাধ্যে কুলোবে না।”

শেষ পর্যন্ত অনেক দর কষাকষির পর গোপালের হাতে পাঁচশত টাকা গুণে দিয়ে তবে পিসি রেহাই পেলেন। প্রতিশ্রুত হয়ে যেন মহারাজকে কিছু যাতে না বলে।

মহারাজের লোক আড়াল থেকে সবকিছু দেখেছে এবং শুনেছে। সে মহারাজকে সব কথা খুলে বলল। সব কথা শুনে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালের বুদ্ধির তারিফ না করে পারলেন না।

গোপালের বরফ-কাটা বুদ্ধি দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারলেন না। কথামত টাকার তিনগুণ অর্থাৎ দেড় হাজার টাকা দিলেন গোপালকে।