পল্লি-মা

পল্লি-মায়ের বুক ছেড়ে আজ যাচ্ছি চলে প্রবাস-পথে
মুক্ত মাঠের মধ্য দিয়ে জোর-ছুটানো বাষ্প-রথে।
উদাস হৃদয় তাকায়ে রয় মায়ের শ্যামল মুখের পানে,
বিদায়বেলায় বিয়োগ-ব্যথা অশ্রু আনে দুই নয়ানে।

স্নেহময়ী রূপ ধরে মা দাঁড়িয়ে আছে মাঠের পরে,
মুক্ত চিকুর ছড়িয়ে গেছে দিক হতে ওই দিগন্তরে;
ছেলে-মেয়ে ভিড় করেছে চৌদিকে তার আঙ্গিনাতে,
দেখছে মা সেই সন্তানেরে পুলক-ভরা ভঙ্গিমাতে।

ওই যে মাঠে গোরু চরে লেজ দুলিয়ে মনের সুখে,
ওই যে পাখির গানের সুখে কাঁপন জাগে বনের বুকে,
মাথাল মাথায় কাস্তে হাতে ওই যে চলে কাল চাষা,
ওরাই মায়ের আপন ছেলে— ওরাই মায়ের ভালোবাসা।

ওরা সবাই সহজভাবে ঠাঁই পেয়েছে মায়ের কোলে,
শান্তি-সুখে বাস করে সব, কাটায় না দিন গণ্ডগোলে,
গোরু-মহিষ যে ঠাঁই চরে, শালিক তাহার পাশেই চরে
কখনো বা পৃষ্ঠে চড়ে কখনো বা নৃত্য করে!

রাখাল ছেলে চরায় ধেনু বাজায় বেণু অশথ-মূলে,
সেই গানেরই পুলক লেগে ধানের খেত ওই উঠল দুলে;
সেই গানেরই পুলক লেগে বিলের জলের বাঁধন টুটে
মায়ের মুখের হাসির মতো কমল-কলি উঠল ফুটে!

দুপুরবেলায় ক্লান্ত হয়ে রৌদ্র-তাপে কৃষক ভায়া
বসল এসে গাছের ছায়ায় ভুঞ্জিতে তার স্নিগ্ধ-ছায়া,
মাথার উপর ঘন-নিবিড় কচি কচি ওই যে পাতা,
ও যেন মার আপন হাতে তৈরি করা মাঠের ছাতা!

ঘাম-ভেজা তার ক্লান্ত দেহে শীতল সমীর যেমনি চাওয়া,
পাঠিয়ে দিল অমনি মা তার স্নিগ্ধ-শীতল আঁচল-হাওয়া,
কালো দিঘির কাজল জলে মিটাল তার তৃষ্ণা-জ্বালা,
কোন সে আদি কাল হতে মা রেখেছে এই জলের জালা।

সবুজ ধানে মাঠ ছেয়েছে, কৃষক তাহা দেখলে চেয়ে,
রঙ্গিন আশায় স্বপ্ন এলো নীল নয়নের আকাশ ছেয়ে;
ওদেরই ও ঘরের জিনিস, আমরা যেন পরের ছেলে,
মোদের ওতে নাই অধিকার— ওরা দিলে তবেই মেলে!

ওই যে লাউয়ের জাংলা-পাতা ঘর দেখা যায় একটু দূরে
কৃষক-বালা আসছে ফিরে নদীর পথে কলসি পুরে,
ওই কুঁড়েঘর— উহার মাঝেই যে-চিরসুখ বিরাজ করে,
নাইরে সে সুখ অট্টালিকায়, নাইরে সে সুখ রাজার ঘরে!

কত গভীর তৃপ্তি আছে লুকিয়ে যে ওই পল্লি-প্রাণে,
জানুক কেহ নাই বা জানুক— সে কথা মোর মনই জানে!
মায়ের গোপন বিত্ত যা তার খোঁজ পেয়েছে ওরাই কিছু
মোদের মতো তাই ওরা আর ছোটে নাকো মোহের পিছু।

(সংক্ষেপিত)