একবার গোপাল পাড়ার এক মুদির দোকান থেকে বাকি খেয়েছে। অনেক দিন হয়ে গেল সে দেনা শোধ করছে না। তখন মুদি রেগে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে আরজি জানাল।
দেনা ছিল পাঁচ টাকা, কিন্তু মুদি সাত টাকার দাবিতে মহারাজার কাছে নালিশ করল।
রাজার তলব পেয়ে গোপাল রাজসভায় গেল এবং বললে, “সাত টাকা নয় হুজুর, পাঁচ টাকা দেনা। আমি ক্রমে আস্তে-আস্তে শোধ করব। দয়া করে আমায় কিস্তি-বন্দী করবার হুকুম দিন।”
মহারাজের বা মহাজনের তাতে আপত্তি ছিল না, কিন্তু গোল বাধলো দেনার পরিমাণ নিয়ে। পাওনাদার বলে, সাত টাকা; দেনাদার বলে, পাঁচ টাকা। অবশেষে মুদির খাতা তলব করা হলো।
দেখা গেল—খাতা অনুসারে দেনা দাঁড়ায় সাত টাকা। গোপাল মুদির খাতা ভালভাবে দেখে বললে, “হুজুর! এই যে দেখুন, কত বড় জোচ্চুরি। যে—ক’দিন অড়হরডাল নিয়েছি, সেই ক’দিন মুদি আমার নামে ঘি লিখে রেখেছে। অথচ আমি কোন দিন অড়হরডালে ঘি খাই না। আমি গরীব মানুষ কি ঘি খেতে পারি? প্রতিদিন আমাদের কি সম্ভব অড়হরডালে ঘি খেতে পারা?”
মুদি বললে, “দেখুন হুজুর, কত বড় মিথ্যে কথা বলছে। ঘি না দিয়ে কেউ অড়হরডাল রান্না করে খেতে পারে?”
মহারাজেরও তাই মনে হলো। মহারাজের নিজের বাড়িতে যখনই অড়হরডাল রান্না হয়, তখনই তাতে প্রচুর ঘি দেওয়া হয়। কাজেই গোপাল নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলেছে।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মুদিকে সাত-টাকারই ডিক্রী দিলেন। কি আর করবে! ডিক্রী-অনুযায়ী গোপাল বাধ্য হয়ে মুদির ডিক্রী শোধ করল।
কিন্তু মুদি যে গোপালকে ঠকিয়ে টাকা নিয়েছে, এ রাগ তার কিছুতেই গেল না। সে এর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবল।
মনে-মনে সে ফন্দী আঁটতে লাগল — কী করে এই মুদিকে জব্দ করা যায়। হঠাৎ একদিন সে একটা বুদ্ধি বের করল।
সেবছর গোপালের বাড়িতে খুব ভাল আখের চাষ হয়েছিল। তাই সে কিছু আখের-গুড় তৈরি করল।
তারপর বেশ কিছুদিন মুদির সঙ্গে সে এমনভাবে আলাপ-ব্যবহার করতে লাগল যে, মুদির ভুলক্রমেও সন্দেহ হল না গোপাল তাকে জব্দ করবার ফন্দী করছে।
গোপাল একদিন কথা-প্রসঙ্গে মুদিকে বললে, সে কিছু আখের গুড় খুব সস্তায় বিক্রি করতে চায়—সামান্য লাভ রেখেই বেচে দেবে। টাকার বিশেষ প্রয়োজন। সস্তা দামের কথা শুনে মুদি কিছু গুড় কিনতে চাইল।
গোপাল নগদ টাকায় গুড় বিক্রি করতে রাজি হলো। নগদ টাকা দিয়ে সস্তায় পিপে-ভর্তি গুড় কিনে মুদি গরুর গাড়ি করে আনন্দে বাড়ি চলে গেল।
কয়েকদিন পরে পিপে খুলে সে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। কি সর্বনাশ! উপর দিকটায় সামান্য গুড় আছে বটে, কিন্তু তার তলায় যে সবই বালি মেশানো ইট সুরকির কুচি দানা।
হায় হায় করে মুদি কাঁদতে লাগল। মনে মনে তার রাগ হলো।
গুড় বিক্রির টাকা দিয়ে গোপাল ছেলে, মেয়ে, বৌ নিয়ে মনের আনন্দে বেশ কয়েকদিনের জন্য বাইরে বেড়াতে চলে গেল।
কিছুদিন অনেক খোঁজাখুঁজি পরে একদিন মুদি গোপালকে খুঁজে পেল। গুড়ের তলায় বালি সুরকির কথা বলে চোটপাট শুরু করতেই গোপাল বললে, “চটো ক্যান মুদি ভাই? ঘি ছাড়া অড়হরডাল ব্যাচন যায় না, আমি বালি-সুরকি ছাড়া সরেস দানা গুড় বেচুম ক্যামনে?” এই বলে হেসে হেসে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।